-"হ্যালো,মা? তোমার টিকিটটা কাটলাম,একটু আগে।পাঠিয়ে দেবো। সতেরো তারিখ দুপুর দুটোয় ফ্লাইট। আমি এয়ারপোর্টে থাকবো।"
-"আচ্ছা।তোর জন্য কি বানিয়ে আনবো? আমের আচার বানিয়েছি তোর পছন্দের। টক মিষ্টি!"
-"এনো। তবে আর কিচ্ছু আনতে হবে না।ব্যাগপত্তর ভারি হয়ে যাবে।তুমি শুধু ক'টাদিন আমার কাছে এসে থাকো।তোমার গলা জড়িয়ে একটু শান্তিতে ঘুমতে চাই।আর কিচ্ছু চাই না।"
আজকাল কোনকিছুই ভালোলাগে না। গান গাওয়া তো দূর, শেষ কবে গান শুনেছি তাই মনে পড়ে না।বারান্দায় শখের ঝুল দোলনাটায় দোল খেতে খেতে গুনগুনিয়ে গান গাইলেই, বাপি পিছনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতো। মায়ের আচার বানানোর শখ আর বহ্নিশিখার খাওয়ার।বাপি দেখলেই রাগারাগি করতো।মা কে বলতো,তুমি এসব খাইয়ে খাইয়ে মেয়েটার গানের গলাটা নষ্ট করছো।কোথায় হারিয়ে গেছে সেই সব দিন! আর এসব ভালোলাগেনা খেতে!
সেই যে বাড়ি ছেড়ে আসা! সেই শেষ। আর যাওয়া হয় নি! মা কতোদিন আসতে বলেছে।সাহস হয়নি।যে বাড়িটা থেকে বড় গলা করে বেরিয়ে এসেছিলাম,সেই মুখ তো আর নেই! বাপি সেই আঘাতে,ভিতরে ভিতরে যে কষ্ট পেয়েছিল,তা তো আর ফেরত হবে না!নাহ্ কেউ দোষারোপ করেনি।তবে এটুকু বুঝতে তো কষ্ট হয় না,বাপির চলে যাওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারন ছিল।
**********
-"ম্যাডাম, ওই স্যার আজকেও এসেছিল।আমি বলে দিয়েছি আপনি অফিসে নেই।জোর করে ঢুকতে চাইছিল।বললো আবার আসবে!"
-" ভালো করেছো সুশান্ত।ধন্যবাদ।"
বেশ কিছুদিন ধরে আয়াংশ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।বহ্নি দেখা করেনি।নাম শুনলেও আজকাল ঘেন্না হয়।একটা মানুষ জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে।কোনো অনুতাপ নেই।বাড়ি ফেরার রাস্তা নেই।আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব সবার সাথে সম্পর্ক চলে গেছে।শুধু এই মানুষটাকে বিশ্বাস করে,ভালোবেসে। আজ আর ভালোবাসা শব্দটাও বলতে ইচ্ছে করে না।বিতৃষ্ণা হয়। অনুভূতিগুলোই মরে গেছে!
টেবিলে একগাদা কাজ জমে গেছে।এভাবে কাজ হয়! মন বসানোই মুস্কিল!আজকাল প্রায় প্রায়ই অফিসে এসে উৎপাত শুরু করেছে। কতোদিন এভাবে আটকে রাখা যায়! সবাই কি আর বোঝেনা! আজ কিছু না বললেও,দুদিন পর কানাঘুষো শুরু হবে।তাছাড়া সুস্হ অবস্হায় থাকে কি না কে জানে! ফাইলগুলো কখন ঝাপসা হয়ে গেছে টেরই পায় নি বহ্নিশিখা।রুমালটা বের করে চোখের জলটা মুছে নেয়।
************
আজ ভাবে কেন সেদিন পরিধির দাদার রিসেপশনে গিয়েছিল! এতো মানুষের ভিড়ে ওর সাথেই কেন বিশেষ পরিচয় হয়েছিল।অন্য কারো সাথেও তো আলাপ হতে পারতো! নতুন বৌয়ের পিসতুতো দাদা আয়াংশ। কলকাতা থেকে গিয়েছিল।একটা দিনের হাসিঠাট্টা, ফোন নম্বর বিনিময় যে এতদূর গড়াবে সেদিন বহ্নিশিখা নিজেও ভাবেনি।সেদিন যখন,বিয়েবাড়ি থেকে পরিধির দাদার গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল আয়াংশ, ভিতরে ভিতরে অদ্ভূত একটা অনুভূতি হয়েছিল।নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হচ্ছিল।পরিধি সবার আড়ালে, গাড়ির চাবিটা দিয়ে চোখ টিপে বলেছিল দারুন মানিয়েছে কিন্তু।বাড়িভর্তি লোকজনের আড়ালে আরেকটা নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল!
বাড়ির একটু দূরে আয়াংশকে নামিয়ে দিতে বলেছিলাম।কেন যেন মনে হচ্ছিল বাপি জিজ্ঞেস করলে কি বলবো! নতুন বৌয়ের পিসতুতো দাদা,যে নিজেই গেষ্ট সে কি করে গাড়ি করে পৌঁছে দেয়! সব কথা বড়দের বোঝানো যায় না।"কাল একবার এয়ারপোর্টে আসতে পারবে?" গাড়ি থেকে নামার সময় আয়াংশের কথায় থমকে তাকায় বহ্নি।"কাল চলে যাওয়ার আগে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করবে!" সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আয়াংশের কথা গুলোর মধ্যে কিছু একটা ছিল।বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠেছিল মুহুর্তেই।ছোট্ট করে 'আসি' বলেই তাড়াতাড়ি নেমে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।কেউ দেখলে মুস্কিল! সত্যিই বাড়ি ফিরে সত্যিটা বলতে পারেনি বহ্নি, বলেছিল ওদের ড্রাইভার পৌঁছে দিয়েছে।
**************
"আমি কিন্তু সেদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম!"
এই ফোনটারই অপেক্ষায় যেন দুটোদিন ঘুম হচ্ছিল না! সেই দিন থেকে একটা মানুষের সাথে ধীরে ধীরে নিজের সবটুকু কিভাবে জড়িয়ে গেল বহ্নি টেরই পায়নি। দুটো শহরে দুটো মানুষ কিন্তু সারাক্ষণ যেন তার কাছে মনটা পড়ে আছে।বেশ কিছুদিন পর পরিধিকে জানিয়েছিল।পরিধি মজা করে বলেছিল ঘটকালিতে আমি কি পাবো?
তার দিন সাতেক পরেই সব বদলে গেল। পরিধিকে ওর বৌদি আয়াংশের ব্যাপারে খুব ভালো কিছু জানায় নি। ভীষন বদরাগী। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে। পরিধির কথা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এতদিন ধরে যে মানুষটার সাথে দিনরাত কথা বলছি সে এমন হলে টের পাবো না! হতে পারে!
আয়াংশকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম। খুব হেসেছিল। বলেছিল,"আচ্ছা কে রাগী নয় বলো তো? অন্যায় দেখলে তোমার রাগ হয় না? আর ড্রিংক অল্প স্বল্প করিনা বলবো না।বন্ধুবান্ধবের সাথে,অফিস পার্টিতে হয়ে যায়।তোমার অপছন্দ হলে, চেষ্টা করবো না করার।তুমি পারবে না ছাড়িয়ে দিতে?" এরপর আয়াংশকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করতে একটুও ইচ্ছে করেনি।
আর বন্ধুর ঘাড়ে যাতে দোষ না পড়ে,তাই পরিধি ফোন করে বাপিকে সবটা জানিয়ে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়।আর তাই সবার আগে যোগাযোগের মাধ্যম ফোন বন্ধ হয়ে যায়।বাপি কোনও কথাই শুনতে নারাজ। আসলে বদরাগী,মদ্যপ ছেলের কথা কোন বাবাই বা শুনতে চায়!
***************
দিন সাতেক পরই দরজায় বেল বাজে।ভীষণ অবিন্যস্ত অবস্হায় আয়াংশ।একদিকে বাপি মা আরেকদিকে আয়াংশ। না পারিনি ফিরিয়ে দিতে আয়াংশকে।মনে মনে অনেকদিন আগেই আয়াংশের হয়ে গিয়েছিলাম যে! ভেবেছিলাম কিছুদিনের মধ্যে বাপিকে মানিয়ে নিতে পারবো।
এভাবে জীবনটা বদলে যাবে,কোনওদিনও কি ভেবেছি! কি ভয়ঙ্কর হৃদকম্পন নিয়ে আয়াংশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম তা একমাত্র আমিই জানি। একদম নতুন একটা শহরে,আয়াংশের মাত্র দুজ'ন বন্ধুর সামনে মন্দিরে,মালাবদল,সিঁদূরদান। অনাড়ম্বর বিবাহ।
*******